বঙ্গভূমি লাইভ ডেস্ক: বর্তমানে রণক্ষেত্র কিয়েভ। ভারতীয় সময় বৃহস্পতিবার সকালে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনের বিরুদ্ধে সেনা অভিযানের কথা ঘোষণা করেন। আর তারপর থেকেই ইউক্রেনের রাজধানী কিভে শুরু হয় একের পর এক বিস্ফোরণ। এখানেই শেষ নয়। ক্ষেপণাস্ত্র হামলাও চালাতে থাকে রুশ বাহিনী। যদিও এর সামনে পড়ে কোনওভাবেই পিছু হটেনি ইউক্রেনের সেনা বাহিনী। বরং এই যুদ্ধে একেবারে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কি। তবে আপনি কি আদৌ জানেন জেলেনস্কির আগের পরিচয়? প্রেসিডেন্টের গদিতে বসার আগে তিনি ছিলেন একজন অভিনেতা।
বছর সাতেক আগে একটি হাস্যকৌতুক সিরিজে প্রেসিডেন্টের ভূমিকাতেই অভিনয় করেছিলেন জেলেনস্কি। আর তার কয়েক বছর পরে যে বাস্তবেও তিনি দেশের সর্বোচ্চ নেতা হয়ে উঠবেন, তা হয়তো ভাবেননি কেউই। এক সময় যিনি ছিলেন কৌতুক শিল্প ও অভিনয় জগতের পরিচিত মুখ, সেই তিনিই পরবর্তীতে হয়ে ওঠেন ইউক্রেনের সর্বেসর্বা। এই মুহূর্তে যিনি রুশ বাহিনীর আক্রমণ রুখতে কার্যত একাই নেতৃত্ব দিচ্ছেন।প্রথাগত রাজনৈতিক তালিম না থাকলেও একের এক এক মাইলফলক পেরিয়ে রাষ্ট্রনেতা হয়ে ওঠেন জেলেনস্কি।তবে বারবার তাঁর রাজনৈতিক জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে ওয়াকিবহাল মহল। যদিও এই পরিস্থিতিতে, যেভাবে তিনি দেশের মাটি আঁকড়ে পড়ে রয়েছেন, তাঁর সেই মনোভাবের প্রশংসা করেছেন তাঁর সমালোচকরাও।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, এককালে রাশিয়ার শিল্পীদের ইউক্রেনে আসার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করার পরিকল্পনা করেছিল ইউক্রেন সরকার। সেই সময়ে এই বিষয়ে বাধ সেধেছিলেন খোদ জেলেনস্কিই। তৎকালীন ইউক্রেন সরকারের বিরুদ্ধেও তিনি প্রতিবাদ জানান। যদিও সেই সময় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না তিনি।
১৯৭৮ সালের ২৫ জানুয়ারি দক্ষিণ-পূর্ব ইউক্রেনের ক্রাইভিই রিহ অঞ্চলে জন্ম জেলেনস্কির। সেখানেই বড় হওয়া তাঁর। বাবা ছিলেন অধ্যাপক এবং মা ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার। পাশাপাশি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জেলেনস্কির ঠাকুরদাও লড়াইয়ে নামেন। সেই সময় রেড আর্মির হয়ে যুদ্ধের ময়দানেও নেমেছিলেন তিনি।স্কুলের পড়াশোনার গণ্ডি পেরিয়ে তিনি ভর্তি হন ক্রাইভিই রিহ ইনস্টিটিউট অব ইকনমিক্স-এ। সেখান থেকে আইন নিয়ে পড়াশোনা করেন তিনি। তবে ডিগ্রি লাভ করলেও কোনওদিনই আইনজ্ঞ হতে চাননি জেলেনস্কি।পড়াশোনা শেষ করেই অভিনয়ের দিকে ঝুঁকেছিলেন জেলেনস্কি। তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৭ বছর। সেই সময়ই তিনি নিজের দল নিয়ে অংশ নেন স্থানীয় টেলিভিশন চ্যানেলের একটি কমেডি শোয়ে। আর সেখান থেকেই তিনি নজর কাড়েন জাতীয় স্তরের মাথাদের।সেই সময় তিনি যেখানেই হাত দিচ্ছেন, সেখানেই যেন ফলছে সোনা। ১৯৯৭ সালে সেই কমেডি প্রতিযোগিতাতেও জয়ী হন জেলেনস্কি ও তাঁর দলবল। এরপর ওই বছরই ‘কিভারতাল ৯৫’ নামে নিজের একটি দল খুলে ফেলেন জেলেনস্কি। ১৯৯৮ সাল থেকে শুরু করে ২০০৩ পর্যন্ত ওই দলের সদস্যদের নিয়ে তিনি বিভিন্ন জায়গায় শো করেন। তার মধ্যে ছিল মস্কো-সহ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের একাধিক দেশ।
এরপর ২০০৩ সালে জীবনের বড় মোড় ঘুরে যায় জেলেনস্কির। ওই বছর থেকেই টেলিভিশনের জন্য কমেডি শো তৈরি করতে শুরু করেন তিনি। ২০০৮ সালে তাঁর সামনে আসে আরও বড় সুযোগ। টেলিভিশনের পর্দা থেকে সরাসরি সুযোগ পান বড়পর্দায়। ওই বছরই ‘লভ ইন দ্য বিগ সিটি’ দিয়ে সিনেমা জগতে পা রাখেন জেলেনস্কি। ২ বছর পর আসে তার সিক্যুয়েল ‘লভ ইন দ্য বিগ সিটি-২’। সেখানেও অভিনয় করেন ছিলেন জেলেনস্কি। এর পর একের পর এক সিনেমায় মুখ দেখান তিনি। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ‘অফিস রোম্যান্স’, ‘আওয়ার টাইম’, ‘এইট ফার্স্ট ডেটস’-এর মতো একাধিক ছবি। ২০১৬ সাল পর্যন্ত রুপোলি পর্দায় বেশ কয়েকটি ছবিতে মুখ দেখান জেলেনস্কি।সময় মতো প্রেমও আসে জীবনে। স্কুলের সহপাঠী ওলেনা জেলেনস্কাকে ২০০৩ সালে বিয়ে করেন তিনি। বিয়ের আগে প্রায় আট বছর কোর্টশিপে ছিলেন ওলেনা এবং ভোলোদিমির।তবে সিনেমার চেয়েও বেশি তাঁর জীবনে খ্যাতি এনে দিয়েছিল এক টেলিভিশন শো। ২০১৫ সালে ‘সার্ভেন্ট অব দ্য পিপ্ল’ নামে একটি কমেডি শোয়ে অংশ নেন তিনি। সেখানে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন জেলেনস্কি। সেই শোয়ের মাধ্যমে রাজনীতির বিষয়গুলিকে খানিক বাঁকা চোখেই আক্রমণ করেছিলেন ‘সার্ভেন্ট অব দ্য পিপ্ল’। আর তারপরই রাতারাতি তারকা হয়ে যান জেলেনস্কি।২০১৯ সাল পর্যন্ত সেই সিরিজেই মেতেছিলেন ইউক্রেনবাসী। আর তারপরই আচমকা সরকারবিরোধী এক প্রতিবাদী মুখ নাম লেখান দেশের প্রেসিডেন্ট পদের দৌড়ে। ২০১৮ সালে ‘কিভারতাল ৯৫’ নামেই একটি রাজনৈতিক দল খোলেন তিনি।
পরের বছরই মনোনয়নপত্র জমা দেন তিনি। মাত্র ছ’মাসের মধ্যেই দেখা যায় যে, জনমত সমীক্ষায় প্রেসিডেন্টের সবচেয়ে এগিয়ে জেলেনস্কি। এবং প্রত্যাশা মতো জিতেও যান তিনি। ২০১৯ সালে প্রায় ৭৩ শতাংশ ভোট পেয়ে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী পেত্রো পোরোশেঙ্কোকে হারান জেলেনস্কি।তবে বিপুল ভোটে জিতলেও, প্রচারে তিনি কোনও গুরুতর বিষয় নিয়ে আলোচনা করেননি বলেই দাবি জেলেনস্কির নিন্দকদের। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভরসা রেখেই যে তাঁর ভোটে জেতা, সেই বিষয় নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন তাঁর সমালোচকরা।
Leave a Reply