বঙ্গভূমি লাইভ ডেস্ক: প্রজন্মের পর প্রজন্ম বুঁদ হয়ে থেকেছ তাঁর কোকিলকণ্ঠে। `আয় মেরি ওয়াতম কে লোগোঁ…’ শুনে আবেগতাড়িত না হয়ে পারে না দেশবাসী। লতা মঙ্গেশকরের এই গান চোখের জল ফেলিয়েছিল জওহরলাল নেহরুর।১৫ আগস্ট, স্বাধীনতা দিবসে হোক কিংবা ২৬ জানুয়ারি সাধারণতন্ত্র দিবস, আজও দেশব্যাপী পাড়া, ক্লাবঘরে একটাই গান তালিকার শীর্ষে থাকে- ‘অ্যায় মেরে ওয়াতন কে লোগোঁ..’। যে গানে কণ্ঠ দিয়েছেন লতা মঙ্গেশকর। দেশাত্মবোধক ওই গান শুনলে আজও গায়ে কাঁটা দেয় না, এমন মানুষ বোধহয় খুব কমই রয়েছেন! লতার কণ্ঠে সেই গান শুনে একবার ভরা সমাবেশেই কেঁদে ফেলেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু।
লতার গাওয়া ‘অ্যায় মেরে ওয়াতন কে লোগোঁ..’ আজীবন যে শ্রোতাদের স্মৃতিতে গেঁথে থাকবে, তা বোধহয় আর আলাদা করে বলার প্রয়োজন পড়ে না। দীর্ঘ কয়েক দশকেও সেই গানের জনপ্রিয়তা বিন্দুমাত্র কমেনি। ১৯৬২ সালে তখন সীমান্তে ইন্দো-চিন যুদ্ধ চলছে। একের পর এক ভারতীয় জওয়ান দেশমাতৃকার রক্ষায় শহিদ হয়ে চলেছেন। গোটা দেশের চোখে জল। ঠিক সেই সময়েই ভারত-চীন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে শহিদ সৈনিকদের শ্রদ্ধা জানিয়ে ‘অ্যায় মেরে ওয়াতন কে লোগোঁ..’ গানটি লিখে ফেলেন কবি প্রতাপ। কম্পোজ করেছিলেন সি রামাচন্দ্রণ। সেই দেশাত্মবোধক গান গাওয়ার প্রস্তাব গেল কোকিলকণ্ঠী লতা মঙ্গেশকরের কাছে। গাইলেনও। তারপরের ঘটনাটা ভারতীয় সংগীত দুনিয়ার ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। যার সাক্ষী এই প্রজন্মও।
২০১৪ সালে এক সাক্ষাৎকারে লতা মঙ্গেশকর জানিয়েছিলেন, তাঁর গলায় ‘অ্যায় মেরে ওয়াতন কে লোগোঁ..’ গানটি শুনে নেহরুজি কীভাবে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন। ৫১তম স্বাধীনতা দিবস পূর্তি উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত ছিলেন লতা। সেখানেই ১৯৬৩ সালে, ২৭ জানুয়ারি দিল্লির রামলীলা ময়দানে ঠিক কী ঘটেছিল? ফাঁস করেন সেকথা।
ষাটের দশক। দেশের প্রধানমন্ত্রী পদে জওহরলাল নেহেরু। সাধারণতন্ত্র দিবসের পরদিন রাজধানীর এক অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার প্রস্তাব আসে লতা মঙ্গেশকরের কাছে। রামলীলা ময়দানে আয়োজিত সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন নেহরুও। একেবারে শেষলগ্নে সেই প্রস্তাব আসায় লতা রিহার্সাল করতে পারেননি। যাওয়ার আগে মাত্র একবার গানটি গেয়েছিলেন।অনুষ্ঠানে গান শুরু করলেন লতা। কবি প্রতাপ তাঁকে ট্র্যাক ধরে গাইতে বললেন হঠাৎ! কিংবদন্তী গায়িকা ভাবলেন, তিনি হয়তো কিছু ভুল করে ফেলেছেন! তাই, খানিক নার্ভাস হয়ে যান। কিন্তু গান শেষ হতেই যখন মঞ্চ থেকে নেমে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে দেখা করতে গেলেন, লতা দেখলেন, উনি কাঁদছেন। নেহরুজি বললেন, লতা, তুমি আমার চোখে জল এনে দিলে…।ভারতরত্ন গায়িকা জানিয়েছিলেন, তিনি ভাবতেও পারেননি যে, তাঁর গাওয়া ‘অ্যায় মেরে ওয়াতন কে লোগোঁ..’ গানটি দেশের গণ্ডী পেরিয়ে বিদেশের মাটিতেও জনপ্রিয়তা পাবে। স্মৃতিচারণা করে সেই সময়ে বলেছিলেন, আমি বিদেশে একশোটির ওপর শো করেছি। যখনই কোথাও গাইতে গিয়েছি, শ্রোতারা আমাকে ‘অ্যায় মেরে ওয়াতন কে লোগোঁ..’ গানটি গাওয়ার অনুরোধ পাঠিয়েছেন।দেশ তখন যুদ্ধের ক্ষত কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। সভা-অনুষ্ঠান করে তোলা হচ্ছে টাকা, যাতে সারিয়ে তোলা যায় ক্ষত। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকেই কাঁদিয়ে দিয়েছিলেন সুর সম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকর। তাঁর গাওয়া সেই ‘অ্যায় মেরে ওয়াতন কে লোগোঁ’ আজও আবেগ বাসিয়ে নিয়ে যায় দেশবাসীকে।১৯৬২ সালের ইন্দো-চিন যুদ্ধের পর দেশ তখন কার্যত বিধ্বস্ত। তাবড় শিল্পীদের একছাতার নীচে নিয়ে ত্রাণ সংগ্রহের চেষ্টা চলছে সর্বত্র। অনুষ্ঠানের মাত্র কয়েক দিন আগেই সুরকার কবি প্রদীপ ‘অ্যায় মেরে ওয়াতন কে লোগোঁ’ গানটি ধরান লতাকে। রিহার্শালের সময় নেই বলে প্রথমে ওই গান গাইতে চাননি লতা। কিন্তু সুরকার জেদ ধরে বসায় রাজি হয়ে যান তিনি। সেই মতো ২৭ জানুয়ারি রামলীলা ময়দানের মঞ্চে ওঠেন। কিন্তু তাঁর ওই গানই নাড়িয়ে দিয়েছিল দেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুকেও।
অনুষ্ঠানে নেহরুর পাশাপাশি উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এস রাধাকৃষ্ণনও। কিন্তু বিশিষ্ট মহলের লোকজন, সাধারণ মানুষের সামনে নিজের চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি নেহরু। সাড়ে ৬ মিনিট ধরে গানটি গেয়ে লতা যখন মঞ্চ থেকে নেমে আসেন, সেই সময় নেহরু তাঁকে বলেন, সত্যিকারের ভারতীয় হলে, এই গানে মন কাঁদবেই।শোনা যায়, যখন প্রথম গানটির ভাবনা আসে মাথায়, তখন হাতের কাছে কিছু ছিল না। তাই মাহিম সমুদ্র সৈকতে বসে সিগারেটের প্যাকেটের ভিতরে থাকা ফয়েলে তা লিখে ফেলেন প্রদীপ। লতা চেয়েছিলেন, বোন আশাও গানে তাঁর সঙ্গে গলা মেলান। কিন্তু প্রদীপ একা লতাকে দিয়েই গাওয়ানোর পক্ষে ছিলেন।
Leave a Reply