শুভম সেনগুপ্তঃ বাঙালির জীবনে যেমন ঘাত প্রতিঘাত থাকে, ঠিক তেমনই থাকে প্রত্যাবর্তন। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় (Sourav Ganguly) যেমন প্রত্যাবর্তনের একটি নাম, তেমনই আরও একটি নাম রাজা রায়চৌধুরী। ‘সৌরভ’ বাস্তব। আর রাজা রায়চৌধুরী ওরফে ‘কাকাবাবু’ পাঠ্যচরিত্র হলেও পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের (Srijit Mukherji)পরিচালনায় তিনিও এখন হলমুখী দর্শকের কাছে বাস্তবই বটে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের (Sunil Ganguly) কিশোর মনের অ্যাডভেঞ্চার এই কাকাবাবু সিরিজ।
প্রথমেই বলে রাখা ভাল, এই ছবি বাড়ি বসে, আয়েশ করে ছোট স্ক্রিনে দেখার জন্য নয়। হলে গিয়ে এ ছবি না দেখলে সব আনন্দ, উত্তেজনা মাঠে মারা যাবে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘জঙ্গলের মধ্যে এক হোটেল’ উপন্যাসটিকে ভিত্তি করে পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায় তৈরি করেছেন ‘কাকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’ (Kakababur Protyaborton)। মিশর রহস্য, ইয়েতি অভিযান- এর লোকেশনের পর সৃজিতের কাছে ততোধিক রোমাঞ্চকর স্থান বাছাই একটা পরীক্ষাই বটে। যে পরীক্ষায় মুখার্জিবাবু টপ র্যাঙ্ক করেছেন।
বাংলার সাহিত্যভাণ্ডারে অ্যাডভেঞ্চার নিয়ে যত সৃষ্টি রয়েছে, চলচ্চিত্রের ভাণ্ডারে তার তুলনায় অনেক কম। তা সে বাংলা ছবির পকেটের জোরের অভাবেই হোক, কিংবা এই ধরনের ছবির প্রতি পরিচালকদের অনীহার কারণেই হোক— বাংলা ভাষায় অ্যাডভেঞ্চার ছবির সংখ্যা অতি নগন্য। সেই হিসাবে ‘কাকাবাবু প্রত্যাবর্তন’ তো বটেই, সৃজিত মুখার্জিও পরিচালক হিসেবে বাংলা ছবির ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিখাদ অ্যাডেভঞ্চারের রসাস্বাদন করতে গেলে এই ছবি দেখাই যায়।
আফ্রিকায় রাজা। রাজা রায়চৌধুরী। যার সঙ্গে এ বার মোলাকাত হয়েছে আফ্রিকার রাজার। শুধু তা-ই নয়, হাতি, হায়না, গন্ডার, জ়েব্রা-সহ অসংখ্য বন্যপ্রাণের খাসতালুকে কাকাবাবুর এ বারের অ্যাডভেঞ্চার। অতিমারি-পীড়িত সময় পেরিয়ে আক্ষরিক অর্থেই ‘প্রত্যাবর্তন’, অর্থাৎ কামব্যাক করল কাকাবাবু আর সন্তু। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্পে এ ছবি তৈরি হলেও ফারাক রয়েছে গল্প, প্রেক্ষাপট, চরিত্রনির্মাণে। মাসাই মারার বুকে এক হোটেলে সন্তুকে নিয়ে ছুটিযাপনে এসেছে কাকাবাবু। যখন তাঁরা বিমানবন্দরে নামলেন, তখনই গড়মিলের আঁচ পাওয়া যায়। যে হোটেলে থাকার কথা কাকাবাবু-সন্তুর, জঙ্গলের মধ্যে সেই হোটেল থেকে মাঝে মাঝেই উধাও হয়ে যাচ্ছে পর্যটকরা। হোটেল ব্যবসার রেষারেষি ও কূটনীতি, বন্যপ্রাণের চোরাকারবারে জড়িয়ে থাকা ‘দুষ্টু লোক’রা শেষ পর্যন্ত শান্তিতে থাকতে দেয় না কাকাবাবু-সন্তুকে। এই অভিযানে তাদের সঙ্গে প্রথম থেকেই শামিল হয় এক তৃতীয় ব্যক্তিও।
একটা মজার বিষয় হল, পরিচালক তাঁর জটায়ুকেও এই ছবিতে বসিয়ে দিয়েছেন। না না, এখানে অনির্বাণ চক্রবর্তী জটায়ু চরিত্রে নন, ‘অমলদা’র চরিত্রে। সৃজিত বুদ্ধি করে ছবিতে গুঁজে দিয়েছেন, ‘বাবুদা ফেলুদা বানাচ্ছেন, জটায়ুর খোঁজ করছেন’ জাতীয় মজার সংলাপ। কাকাবাবু-সন্তু-অমলবাবুর কথোপকথনে উঠে এসেছে জঙ্গল আর তার জানোয়ার সম্পর্কিত নানা তথ্য। সংলাপের ফাঁকে ফাঁকে শব্দ নিয়ে খেলা, আফ্রিকার (Africa) মানচিত্র কৌতূহল তৈরি করবে ছোটদের মধ্যে।
ধু-ধু জঙ্গলে কাকাবাবু-সন্তুকে যখন হাতি, গন্ডার এমনকি সিংহ পর্যন্ত আক্রমণ করে, সে সব দৃশ্য দিব্যি উতরে দিয়েছে দক্ষ ভিএফএক্স। শুধু সন্তুকে সাপে কামড়ানোর দৃশ্যটি যদি আরও বিশ্বাসযোগ্য করা যেত ভাল হত। তবে যেটা ভীষণ দৃষ্টিকটু তা হল, ছবির মধ্যে বিজ্ঞাপনী প্রচার ঢুকিয়ে দেওয়ার প্রবৃত্তি।
এক কথায় ছবিটি বড্ড স্লো। তবে আফ্রিকার দর্শন নিঃসন্দেহে ছাপিয়ে গেছে সেই অভিযোগ। হলে বসে যখন আফ্রিকা ভ্রমণ করছিলাম, তখন ভুলেই গেছিলাম কাকাবাবু আর সন্তু ‘দুষ্টু লোক’ খুঁজতে বেড়িয়েছেন।
মিশর রহস্য, ইয়েতি অভিযান এর সঙ্গে এ ছবির তুলনা করলে বলা যায়, এ বারে কাকাবাবুর ‘অ্যাকশন’ তুলনায় কম। তবে রাজা রায়চৌধুরী রূপে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের দাপট আগের মতোই বহাল। তাঁর হাত ধরে দর্শক এ বারেও নিজেদের সন্তুর আসনে বসিয়ে আফ্রিকা পাড়ি দিতে পারেন স্বচ্ছন্দে। সন্তুর চরিত্রে আগের তুলনায় পরিণত হয়েছেন আরিয়ান। অনির্বাণ চক্রবর্তী একেনবাবু আর জটায়ুর খোলস ছেড়ে আরও একধাপ এগিয়ে খেলেছেন এই ইনিংসটি।
ইনিংসের কথাই যখন বললাম, তখন রূপম ইসলামের (Rupam Islam) কণ্ঠে ‘ফিরে এলো কাকাবাবু’ ঝোড়ো ব্যাটিং অবশ্যই। সঙ্গে ‘চন্দ্রবিন্দু’র গাওয়া ‘তিন তিরিক্ষে নয়’ও তেমনই উপভোগ করার মতো। ছবির আরেকটি বাড়তি আকর্ষণ হল পরিচালক সৃজিতের মি: সহায় নামের একটি চরিত্রে ক্ষণিকের আবির্ভাব। প্রথমটায় সন্দেহজনক মনে হলেও, শেষ পর্যন্ত এই সহায়ই প্রকৃত সহায় হয়ে কাকাবাবুদের পাশে এসে দাঁড়ান। ছোট্ট চরিত্র, কিন্তু সৃজিতের উজ্জ্বল এবং চটকদার উপস্থিতি বেশ ভালই লাগে।
আসলে এই ছবির আসল নায়ক মাসাইমারার (Maasai Mara) চোখ জুড়ানো এবং মন ভোলানো লোকেশন। গল্পপ্রিয় দর্শক জানেন, দেখতে যাবেন আফ্রিকার বুনো সৌন্দর্য। সেখানে কোনও ফাঁক বা ফাঁকি রাখেননি সৃজিত। শেষ কথায়, এ ছবির তৈরি করার পিছনে ক্রেডিট যতখানি সৃজিতের, ততটাই সিনেমাটোগ্রাফার সৌমিক (Soumik Halder) হালদারের। সৌমিক না হলে, এ ভাবে ধরা যেত না মাসাই মারাকে।
Leave a Reply