বঙ্গভূমি লাইভ ডেস্ক: দেখা হয়নি চক্ষু মেলিয়া/ ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া/একটি ধানের শিষের উপরে/একটি শিশিরবিন্দু।
সরথ ও গীতার জীবনদর্শন নিহিত আছে বিশ্বকবির এই ভাবনায়। ঘুরে বেড়ানোই তাঁদের নেশা। আক্ষরিক অর্থেই তাঁদের পায়ের তলায় সর্ষে। ঘরের চৌকাঠ ছাড়িয়ে বেরিয়ে পড়েছেন বহুদিন, সত্যিই এতদিনে ঘুরে ফেলেছেন বহু ক্রোশ। পর্বতমালা, সিন্ধুও দেখে ফেলেছেন। পাশাপাশি আবিষ্কার করেছেন নতুন নতুন জায়গা। দেশের গণ্ডী ছাড়িয়ে পৌঁছে গিয়েছেন বিদেশে। সাইকেল, বাইক থেকে শুরু করে এরোপ্লেন- দূরত্বের নিরিখে বদলাতে থেকেছে বাহন। বাড়িতে ঢুকলেই মন বলে পালাই-পালাই। এঁদের রোমাঞ্চকর গল্প শুনলে নতুন প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা বোধহয় একটু অবাকই হবেন। এতকিছু শুনে দুই ভ্রমণসঙ্গীর সম্পর্কে জানার ইচ্ছেটা প্রবল হচ্ছে নিশ্চয়ই! তাহলে পরিচয়টা দিয়েই দেওয়া যাক। একজন কেরলের ত্রিচূড়ের বাসিন্দা সরথ কৃষ্ণন। আর সরথের ঘোরার সঙ্গী, তাঁর ৬৪ বছরের মা গীতা।
সরথ পেশায় একজন ব্যবসায়ী। বড় হতে হতেই দেশ-বিদেশ ভ্রমণের নেশাটা তাঁর মাথায় চেপে বসে। প্রথম প্রথম একলাই বেরিয়ে পড়া। বাইকই ছিল চার বাহন। কাজের ফাঁকে বাইক নিয়ে ঘোরাই ছিল তাঁর নেশা এবং ভালোবাসা। ঘর ছাড়িয়ে নতুন নতুন জায়গার মোহ তাঁকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াত। এরপর ব্যবসার সূত্রে ঘুরতে হত নানা স্থানে। অচেনা কোথাও গেলেই, সরথ বেরিয়ে পড়তেন এক পরিব্রাজকের চোখ দিয়ে, তা আবিষ্কার করতে। চলে যেতেন সাইটসিংয়ে। নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচয়, তাঁদের জীবন যাত্রা, প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ! বাড়ি ফিরে সেই অভিজ্ঞতার ঝুলি উজাড় করে দিত মায়ের সামনে। ছেলের চোখ দিয়ে মা’ও দেখতেন, নতুন জায়গা, নতুন মানুষ। আর মনে লালন করতে থাকেন একটি সাধ, ছেলের সঙ্গে তিনিও যদি বেরিয়ে পড়তে পারতেন! চর্মচক্ষে দেখতে পেতেন সবকিছু। মায়ের মনের কথা ছেলেকে যে বুঝতেই হবে! আর দেরি নয়। ভ্রমণপিপাসু সরথের সঙ্গী হলেন মা গীতা।
গৃহবধূ গীতা তিন সন্তানের মা, প্রথম প্রথম এই ছেলের আবদারে বিশেষ পাত্তা দিতেন না। কিন্তু নাছোড় ছেলের জেদের কাছে হার মেনে একদিন রাজি হয়েই গেলেন। এখন স্মৃতির পাতা উল্টে বলতে থাকেন, ‘এই বাড়ির চার দেওয়ালের বাইরে না বোরোলে বোধহয় কোনওদিনই জানতে পারতাম না, জীবনে এতদিন কী থেকে বঞ্চিত ছিলাম। আমার বয়স এখন ৬৪। ডায়াবেটিসের রোগী। এই বয়সে এসে বিশ্বভ্রমণ আমার কাছে ছিল কষ্টকল্পনা। কিন্তু তাও সম্ভব হচ্ছে। আজ আমার থেকে খুশি আর ক’জন আছে! পরের ট্রিপের প্ল্যানিং শুরু হয়ে গেছে।’ গীতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, প্রতি তিনমাস অন্তর দূরে কোথাও, মা-ছেলের বেরিয়ে পড়া চাইই।
সরথ বলেন, ‘শুরুটা হয়েছিল ২০১৫ সালে। প্রথমে মাকে বাড়ির বাইরে বের করাই ছিল বেশ কষ্টসাধ্য। মুম্বইয়েক এক বন্ধুর সদ্যোজাত সন্তানকে দেখাতে নিয়ে যাব বলে মাকে অবশেষে রাজি করাই। একটু আপত্তি থাকলেও, যেহেতু দু’দিনের ট্রিপ, মা রাজি হয়ে যান।মুম্বই ঘুরে মাকে নিয়ে যাই নাসিক। ধর্মকর্ম নয়, মায়ের মাথা ঘুরিয়ে দেয় মন্দিরগুলির অপূর্ব মেরাকি নির্মাণশৈলি।তারপর অজন্তা-ইলোরার গুহাচিত্র! এক অনাস্বাদিত আনন্দ দেখেছিলাম মায়ের চোথেমুথে।’ .
এরপর মা ছেলে রাত কাটায় একটি আঙুর বাগানে। দ্রাক্ষারস থেকে তৈরি উৎকৃষ্ট মদিরার সঙ্গে্ গীতাম্মার পরিচয় সেখানেই। নাসিক চলে যাওয়া পুনে সংলগ্ন লোনাভালায়।এরপর মুম্বই হয়ে কেরল ফেরত। সরথ বলেন, ‘আসলে যা হল, দু’দিনের ট্রিপ ১১ দিনে গিয়ে ঠেকল। তারপর থেকে মা-ছেলের আর থামা নেই।’
পরের গন্তব্য ঐতিহাসিক ওয়াঘা সীমান্ত। একে একে চোখ জুড়িয়ে যাওয়া হিমাচলের উষ্ণ প্রস্রবণ, তিব্বতের মানসরোবর লেক থেকে মাউন্ট এভারেস্ট, ছেলের হাত ধরেই অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য উপভোগ করেছেন গীতাম্মা। প্রৌঢ়ত্ব ষেখানে বাধা হয়েছে, ছেলে পাঁজাকোলা করে মাকে পার করে দিয়েছেন সেই দুর্গমতা। এভারেস্ট আর কৈলাশ ভ্রমণের কথা উঠলে সরথ আর গীতার চোখ এখনও চকচক করে ওঠে। ৫০০সিসির বুলেটে চড়ে তুষারাবৃত রোটাং পাস পেরোনোর স্মৃতিতে আজও রোমাঞ্চিত হন মা-ছেলে।
ভরা পূর্ণিমায় কচ্ছের রান দেখার যে অপূর্ব অভিজ্ঞতা তা ভাষায় প্রকাশ করতে গিয়ে বারবার সুখ স্মৃতিতে ডুবে যান সরথ-গীতা। দিনের বেলায় উটের পিঠে বালিয়াড়ি সফর একরকম । আর রাতে পূর্ণিমার চাঁদের জ্যোৎস্না মাখা কচ্ছের উপকূলের সৌন্দর্য্য আরেক রকম। সাদা লবণের সৈকতে নেমে এসেছে গোটা আকাশটা। চারদিক ভরে উঠেছে স্বর্গীয় আলোর ছটায়।
বয়সকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কীভাবে ভালো থাকা যায়, গীতাম্মাকে না দেখলে তা বিশ্বাস করা যেত না। অজানাকে জানা আর অচেনাকে চেনাই, তাঁর ভালো থাকার অনুপ্রেরণা। যোগাভ্যাস আর ব্যায়াম এবং বিশেষ পদ্ধতিতে শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ, ৬৪ বছরের যুবতীর রোজকার রুটিন। যা তাঁকে অতিরিক্ত উচ্চতায়ও ফিট রাখে আর অফুরান জীবনীশক্তির জোগান দেয়। করোনাকাল অবশ্য মা-ছেলের অভিযানে অনেকটাই বাদ সেধেছে। তবে ঘরবন্দি থেকেও সরথ-গীতার পরবর্তী ট্রিপের জম্পেশ প্ল্যানিং কিন্তু তৈরি।
Leave a Reply