বঙ্গভূমি লাইভ ডেস্ক: ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের( Russia-Ukraine war) দরুন বিশ্বে বাড়তে চলেছে শরণার্থী(refugee) সংকট। ইউক্রেনের বধ্যভূমি থেকে প্রাণ বাঁচাতে ইতিমধ্যেই লাখো লাখো মানুষ ছিন্নমূল অবস্থায় পাড়ি দিয়েছেন প্রতিবেশী রাষ্ট্রে। শনিবার রাষ্ট্রসংঘ(United Nations) জানিয়েছে, ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা শুরুর পর প্রায় ১২ লক্ষ মানুষ সে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। এক সপ্তাহেরও কম সময়ে ইউক্রেনের জনসংখ্যার ২% এরও বেশি মানুষ দেশ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের(European Union) আশঙ্কা, আরও ৪০ লক্ষ মানুষ ভিটেহারা হয়ে, ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্রে শরণ নিতে পারেন। এবং এদের সকলকে দুহাত বাড়িয়ে আশ্রয় দিতে প্রস্তুত ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত সব রাষ্ট্রই। তারা শুধু আমেরিকা-ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, রোমানিয়া, স্লোভাকিয়া বা মলডোভা নয়, আক্রমণকারী রাশিয়া এবং বেলারুশেও পালিয়ে গেছেন।

গত বৃহস্পতিবারই রাষ্ট্রসংঘ(United Nations) জানিয়ে দেয়, যুদ্ধের ফলে শরণার্থীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। ইউক্রেন থেকে প্রতিবেশী দেশগুলিতে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে যাচ্ছেন দলে দলে মানুষ। ট্রেন, গাড়ি এমনকি পায়ে হেঁটেও বহু মানুষ পাড়ি দিচ্ছেন প্রতিবেশী দেশগুলিতে। রাষ্ট্রসংঘের শরণার্থী(refugee) বিষয়ক হাইকমিশনার সর্বশেষ পরিসংখ্যান দিয়ে জানিয়েছেন, ইউক্রেন ছেড়ে পালিয়ে আসা মানুষের অর্ধেকই প্রতিবেশি পোল্যান্ডে আশ্রয় নিয়েছেন। সেদেশে ৬ লাখ ৫০ হাজার ইউক্রেনীয় আশ্রয় নিয়েছেন। দেড় লাখ মানুষ হাঙ্গেরিতে, বাকিরা ইউরোপের অন্যান্য দেশে আশ্রয় নিয়েছেন। প্রতিবেশি মলদোভা, স্লোভাকিয়া, রোমানিয়ায় বিপুল শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছেন। অত বেশি সংখ্যায় না হলেও, রাশিয়ার ভূখণ্ড এবং সঙ্গে বেলারুশেও ঢুকে পড়েছেন যুদ্ধে( Russia-Ukraine war)সর্বাহারাদের অনেকেই। মূলত রুশ বংশোদ্ভূত ইউক্রেনের নাগরিকরাই নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে রাশিয়ায় পাড়ি দিচ্ছেন বলেন দাবি করা হয়েছে কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে। পাশাপাশি, রাশিয়ায় প্রায় ৪০ হাজার ইউক্রেনীয় নাগরিক চলে গেছেন। বেলারুশেও আশ্রয় নিয়েছেন প্রায় দুই হাজার ইউক্রেনীয় নাগরিক। সূত্রের খবর,রুশ বাহিনীর হামলায় ইতিমধ্যে বেশ কিছু শরণার্থী(refugee) নিহতও হয়েছেন।

রাশিয়ার হামলার আগে ইউক্রেনে মোট জনসংখ্যা ছিল চার কোটি ৪০ লাখ। ইউএনএইচসিআর((United Nations) বলছে, ‘ইউক্রেনের ভেতর ও বাইরে এখনো অনেক মানুষ আশ্রয়ের খোঁজ করছেন। তাদের সুরক্ষা ও সহায়তা দরকার। ইউক্রেনের পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে, তাতে প্রায় ৪০ লাখ মানুষ ইউক্রেন ছাড়তে বাধ্য হতে পারেন।’ উদ্বাস্তু এই মানুষগুলোর সঙ্গী হল অনিশ্চয়তা, আতঙ্ক আর আশঙ্কা।

গোটা বিশ্ব দেখছে কিভাবে যুদ্ধ আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় শরণার্থী সংকটকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। লাখো লাখো মানুষ পুরোপুরি গৃহহীন বা ফিরে আসার মতো নিমিত্ত মাত্র সম্বলটুকু রেখে সীমান্তের দিকে ছুটে চলেছেন। যুদ্ধক্ষেত্রে মারণ অস্ত্রের দাপটের থেকেও আরও বড় যুদ্ধ করতে নামে ঘরছাড়া ছিন্নমূল মানুষগুলো। একটি যুদ্ধের চিহ্ন হিসেবে দগদগে ক্ষতের মতোই থেকে যায় শরণার্থী(refugee) জীবন। ধ্বংস হয় মানুষের মাথা গোঁজার ঠাঁই, ভেঙ্গে পড়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, জীবন ধারনের জন্য জীবিকার হাহাকার, শেষ হয়ে যায় সামাজিক বন্ধনটুকুও। শুধু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ(Russia-Ukraine war) নয়, দশকের পর দশক, শতাব্দীর পর শতাব্দী শক্তিধরের আগ্রাসন, দুর্বল কোনও দেশকে একেবারে ধুলোয় মিশিয়ে দিচ্ছে আর তার সঙ্গে বাড়ছে শরণার্থী(refugee) সংকট। জানা গিয়েছে এই মুহূর্তে বিশ্বের প্রায় ৩ কোটি ৮০ লক্ষ অর্থাৎ প্রায় ৪ কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন শুধুমাত্র আফগানিস্তান, ইরাক, পাকিস্তান, ইয়েমেন, সোমালিয়া, এবং ফিলিপিন্স, সিরিয়া এবং লিবিয়ার সংঘাতে জর্জরিত এলাকাগুলি থেকে। গৃহহীন এই মানুষগুলোর ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে ঠাঁই পেয়েছেন দেশেরই কোন এক পুনর্বাসন ক্যাম্পে আর যাদের ভাগ্য সহায় নয়, তাঁদের শুধু ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হতে হয়নি ছাড়তে হয়েছে নিজের দেশ। উদ্বাস্তু হয়ে আশ্রয় নিতে হয়েছে অচেনা কোনও দেশে। এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে আন্তর্জতিক সমীক্ষায়। যে রিপোর্টে বলা হয়েছে, গৃহযুদ্ধ, হিংসা, নিপীড়ন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের মত নানা কারণে নিজভূমি ছেড়ে পরবাসী হতে হয়েছে, এই বিপুল সংখ্যক মানুষকে। যে নিদারুন অবস্থায় এই মানুষগুলো দিন কাটাচ্ছেন তা এককথায় অবর্ণনীয়। পাশাপাশি উঠে আসছে, শরণার্থীদের ৮৬ শতাংশ নতুন ঘর বেঁধেছেন উন্নয়নশীল দেশগুলিতে আর ধনী রাষ্ট্রগুলিতে আশ্রয় হয়েছে মাত্র ২৭ শতাংশের।

সমসাময়িক দুনিয়ার শরণার্থী চিত্র বলছে, আমেরিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকার, এল সালভাদর, গুয়াতেমালা এবং হন্ডুরাসে মারাস নামক দুবৃত্তদের দৌরাত্ম্য এতটাই চরম আকার নিয়েছে যে মানুষ তাদের হাত থেকে বাঁচতে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাচ্ছেন। ২০২১-এ এইসব দেশ থেকে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০ লক্ষ।
করোনাকে(covid) রুখতে ৯৯টি দেশ আন্তর্জাতিক সীমানা সিল করায় শরণার্থীর(refugee) স্রোত কিছুটা কমলেও বাড়িয়েছে অন্য দুশ্চিন্তা। বিশ্বের মানবাধিকার সংগঠনগুলি মনে করছে, অন্য দেশে চলে যাওয়ার সুযোগ যেখানে সীমিত, সেখানে গৃহযুদ্ধই আর রাষ্ট্রীয় নিপীড়নই হোক বা পররাষ্ট্রের সঙ্গে সংঘাত, কত না মানুষকে প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই চালিয়ে বাঁচতে হচ্ছে।

অন্যদিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় অঞ্চলে রোহিঙ্গা সমস্যা উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। এই সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর নিজস্ব দেশ বলে কিছুই। বিপন্ন রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের একটা বড় অংশ মহিলা এবং শিশু। রয়েছে সদ্যোজাত আর রয়েছে অতি বয়স্ক মানুষজন, যাদের বিশেষ সাহায্য এবং সুরক্ষা প্রয়োজন।

উল্লেখ্য ২০১৭ থেকে লাগাতার জাতিগত হিংসার শিকার হচ্ছে এই রোহিঙ্গারা। মিয়ানমারে জাতিগত হিংসার শিকার হয়ে সে দেশ থেকে উচ্ছেদের পরই, বিশ্বের শরণার্থী(refugee) তালিকায় যোগ হয় রোহিঙ্গাদের নাম। বর্তমানে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের ৯০ শতাংশ মানুষের বাস বাংলাদেশ এবং মালেশিয়ায়।
উন্নত রাষ্ট্রগুলির মিডিয়া গোষ্ঠী আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় এমন ধারণা দিয়ে রেখেছে যে শরণার্থী সমস্যা মেটাতে উন্নত দেশগুলি তাদের সাধ্যের বাইরে গিয়ে কাজ করছে কিন্তু বেশ কিছু আন্তর্জাতিক সংগঠনের রিপোর্টে উঠে এসেছে একেবারে অন্য কাহিনী। বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশগুলি বহুক্ষেত্রেই নিজের দেশের বিপন্ন মানুষকেই নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। রাষ্ট্র মুক ফেরানোয়, একটু শান্তির আশায় পরদেশে যাওয়া নিশ্চিত করেছেন তাঁরা। আর ঠিক উল্টো দিক থেকে উন্নয়নশীল এবং স্বল্পোন্নত রাষ্ট্রগুলি তাদের সাধ্যের বাইরে গিয়েও শরণার্থীদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। আমনেস্টি ইন্টারন্যাশানলের রিপোর্ট বলছে, উন্নয়নশীল দেশগুলো ৮৫ শতাংশ শরণার্থীর নিশ্চিত আশ্রয় হয়ে দাঁড়িয়েছে ।
আরও একটি চাঞ্চল্যকর রিপোর্ট বলছে এই মুহূর্তে দুনিয়াজুড়ে যত সব মানুষের মাথায় শরণার্থী(refugee) তকমা জুটেছে তাদের অর্ধেকই হলো শিশু। মানবাধিকার সংগঠনগুলির মতে অন্তত ১৪ লক্ষ মানুষের অবিলম্বে পুনর্বাসন প্রয়োজন।
২০১৯ এর দিকে পিছন ফিরে তাকালে দেখা যাবে বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ শরণার্থী এসেছিল শুধু মাত্র পাঁচটি দেশ থেকে, সেগুলি হল সিরিয়া, ভেনেজুয়েলা, আফগানিস্তান, দক্ষিণ সুদান এবং মিয়ানমার থেকে। ২০১৯ এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিশ্বের ১২৬টি দেশে ছড়িয়ে রয়েছে সিরিয়ার প্রায় ৬৬ লক্ষ নাগরিক। ইউএনএইচআরসি-র একটি রিপোর্টে বিশ্বব্যাপী শরণার্থীদের ছবি তুলে ধরে বলা হয়েছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী জমানার পর রেকর্ড সংখ্যক শরণার্থীর(refugee) খোঁজ তাঁরা পেয়েছেন । আর তা বজায় রাখতে সবচেয়ে বড় অবদান সিরিয়া আর আফগানিস্তানের।

দ্য ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের রিপোর্ট শরণার্থী সমস্যাকে নিয়ন্ত্রণ করতে একটি বিশ্বজনীন পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে আন্তরিক সহযোগিতা এবং বোঝাপড়ার মনোভাব তৈরি হওয়া এবং অসহায় মানুষগুলির দায় ও দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়া এই মুহূর্তে সময়ের দাবি। পাশাপাশি ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের রিপোর্ট স্পষ্ট উল্লেখ করেছে সম্পদশালী দেশগুলির শরণার্থী(refugee) সংকট থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া চলবে না। এ নিয়ে দায় চাপানো যাবে না গরিব দেশগুলোর উপর। নিজের দেশের সংঘর্ষে বিধ্বস্ত এলাকাগুলির মানুষকে যেমন জীবন-জীবিকার নিরাপত্তা ও সুরক্ষা দিতে হবে, তেমনই যুদ্ধবিধ্বস্ত অন্য রাষ্ট্রের নাগরিকদের দিকে বাড়িয়ে দিতে হবে সাহায্যের হাত।
রাষ্ট্রসংঘের শরণার্থী বিষয়ক এক এজেন্সির রিপোর্ট অনুযায়ী, একদশক আগেও নিজের শিকড় থেকে উচ্ছেদ হওয়া মানুষের সংখ্যা আজ দ্বিগুণ। আরও একটি ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে এই সমীক্ষায়। জানা গিয়েছে, শরণার্থীদের মধ্যে ৪২ শতাংশের বয়স ১৮ বছরের নিচে। আর ২০১৮ থেকে ২০২০-র মধ্যে শরণার্থী পরিবারে জন্ম নেওয়া শিশুর সংখ্যা প্রায় ১০ লক্ষ। আগামীদিনেও এই পরিস্থিতির কোনও উন্নতি হবে না বলেই আশঙ্কা।
Leave a Reply